এই পৃথিবীতে কত মানুষ কতভাবেই না ভাবে। তবে ইতিবাচক ভাবনাগুলো মানুষের হৃদয়ে দাগ কাটে সবসময়ই। কোন কোন মানুষ কেবল নিজের জন্য ভাবে না। যদিও ভাবনার জায়গাটি হয়তো শুরু হয় নিজেকে কেন্দ্র করেই। তেমনি একজন নাসির শিকদার। নিউইয়র্কের ব্রঙ্কস এর এই বাসিন্দা কোনদিন ভাবেনটি তিনি হয়তো এমন কিছু করবেন, যে কারণে অনেক মানুষ তাকে নিয়ে কথা বলবে। অথচ হয়েছে তাই।

ব্যক্তিগত ভাবনা থেকে যে দৌঁড় শুরু করেছিলেন নাসির শিকদার, এরিমধ্যে তা তাকে নিয়ে গেছে অসংখ্য মানুষের কাছে। যে কারণে সেই দৌঁড়কে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চান তিনি। এবার তার সঙ্গে এখন তিনি যুক্ত করেছেন, সার্বজনীন একটি শ্লোগান। ‘ওবেসিটি ফ্রি ওয়ার্ল্ড’ এই বক্তব্য নিয়ে এগিয়ে যেতে চান, বলতে চান ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মুল’। তার জন্য প্রয়োজন একাগ্রতা, প্রচেষ্টা এবং পরিশ্রম, সেটাও তিনি জানেন।

‘নিজেকে নিয়ে ভাবা, নিজেকে সময় দেয়া এবং কায়িক পরিশ্রম’-সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। সেই ভাবনা থেকেই একের পর এক ম্যারাথন দৌঁড়ে অংশ নিচ্ছেন নাসির শিকদার। চলতি বছর, অর্থ্যাৎ ২০২১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর রবিবার ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রান্সিসকো ম্যারাথনে অংশ নিয়ে মূলত আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছিলেন তিনি। সেবার পাহাড়ি পথ আর গোল্ডেন গেইট ব্রিজ পেরিয়ে ২৬ দশমিক ২ মাইল পাড়ি দিয়েছিলেন নাসির। এরপর যেনো এক ধরণের নেশা পেয়ে বসে। সেই সঙ্গে একটি বার্তা ছড়িয়ে দেয়ার প্রত্যাশা নাসিরকে করে তোলে আরও স্বতস্ফূর্ত। তিনি চান মানুষেরা তাদের শরীরে অহেতুক মেদ নিয়ে বসবাস করবে না। মানুষের সবার আয়ু এক না।

‘তবুও যে যতদিন বাঁচবেন, সুস্থ্য থাকার চেষ্টা করবেন’-এমনটাই মনে করেন তিনি। নাসির শিকদার মনে করেন, ‘সবার পক্ষে সমানভাবে সুস্থ্য থাকা সম্ভব নয়। এরপরও সবাই যদি চেষ্টা করি সুস্থ্য থাকার, তাহলে হয়তো জীবনমানে কিছুটা হলেও পরিবর্তন নিয়ে আসা সম্ভব। আমি বলতে চাই, চলুন চেষ্টাটা করি’। তিনি বলেন, ‘জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জীবন আসলে শেষ হয়ে যায় না। যতদিন বেঁচে থাকা, ততদিন চেষ্টাটা চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন’।

‘ওবেসিটি ফ্রি’ পৃথিবীর ডাক নিয়ে দৌঁড়ান নাসির। আজকালকার এই পৃথিবীটা ফাস্টফুড নির্ভর হয়ে উঠছে ক্রমাগত। অনেকক্ষেত্রেই শারীরিক পরিশ্রম বিদায় নিচ্ছে। মানুষ হয়ে পড়েছে প্রযুক্তিনির্ভর। বিশেষ করে শিশুরা আজকাল খেলাধুলা করে না। তারা মোবাইল, কম্পিউটার ও ট্যাব নির্ভর হয়ে উঠছে। যে কারণে ওবেসিটি দুনিয়াজুড়ে বড় সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে। যা থেকে পরিত্রানের জন্য পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু এমন ভাবনা তার মাথায় কিভাবে এলো? নাসির শিকদারের বাবা ৫৩ বছর বয়সে মারা যান। ফলে মধ্য বয়সে এসে তার মধ্যেও একটা দুশ্চিন্তা পেয়ে বসে। অনেকটা যেনো জীবনের হালই ছেড়ে দেন হঠাৎ করে। এ নিয়ে ফেইসবুকে একটি পোস্টে তিনি লেখেন, “আমি হয়তো আর তিন বছর বাঁচবো”। না বাঁচার কারণ হিসেবে হার্টে ব্লক, হাই ব্লাড প্রেশার, হাই কোলেস্টেরলসহ বিভিন্ন রোগের কথা জানান।

দিনে ১৪টিও বেশি ওষুধ খেতে হোতো তাকে। ৯২ কেজি ওজনের বিশাল মেদবহুল অস্বস্তিকর শরীর তো ছিলই। আর তার বাবা যখন ৫৩ বছর বেঁচেছেন, বংশগুতভাবে হয়তো তিনিও সেই পথে হাঁটছেন-এমন দুশ্চিন্তায় হতাশার দিন কাটাতে থাকেন তিনি। ঠিক সেইসময় তার স্ত্রী কবি বেনজির শিকদার এগিয়ে আসেন মমতা নিয়ে। তিনি একজন জনপ্রিয় লাইফস্টাইল বিশেষজ্ঞের একটি ভিডিও স্বামীকে দেখতে বলেন। সেই ভিডিও দেখেই বদলে যেতে থাকে নাসিরের ভাবনা। বদলে যাওয়া ভাবনা প্রভাব ফেলে জীবন আচরণে। মরে যাওয়ার আগেই তিনি আর মরতে চান না। তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন।

প্রথমে একটু একটু জগিং থেকে দূরত্ব বাড়াতে থাকেন। সুস্থ্যতার জন্য খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনেন। জীবন নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। তার ওজন কমতে থাকে, শরীরে জেগে ওঠে স্পন্দন। কি গরম কি ঠাণ্ডা, তার রুটিনে কোন ব্যাত্যয় ঘটে না। লোভনীয় খাবারের মায়াজাল তাকে বিভ্রান্ত করতে পারে না। বরং তিনি অন্যদের বলতে চান, ‘চলুন নিজেকে একটু সময় দিন এবার। একটু পরিশ্রম করুন। নিয়ম মেনে জীবন যাপন করুন। আর খাদ্যাভ্যাসটাও করুন স্বাস্থ্যসম্মত’।

এরিমধ্যে বেশ কয়েকটি ম্যারাথনে অংশ নিয়েছেন নাসির শিকদার। নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডের হ্যাম্পটনস ম্যারাথন অংশ নিয়েছেন অক্টোবরে। এরপর অংশ নেন বস্টন ম্যারাথনে। ঐতিহ্যবাহী নিউইয়র্ক ম্যারাথনে অংশ নিয়ে ‘ওবেসিটি ফ্রি ওয়ার্ল্ড’ এর বার্তা ছড়িয়ে দেন সবার মাঝে। যা অসংখ্য মানুষের দৃষ্টিতে পড়েছে। এরিমধ্যে মূলধারার কয়েকটি গণমাধ্যমেও সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন। আগ্রহীরা কাছে এসে কথা বলেছেন, জানতে চেয়েছেন তার ভাবনা।

বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুরে জন্ম নাসির শিকদারের। বাবার নাম মোহাম্মদ রিয়াজ শিকদার আর মা হেনা বেগম। বাবা মায়ের দশ সন্তানের মধ্যে তিনি চতুর্থ। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্ব বিভাগে। বর্তমানে বসবাস করছেন নিউইয়র্কে। একটি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানীতে আইটি বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন তিনি। স্ত্রী বেনজির শিকদার, দুই ছেলে এবং এক মেয়ে নিয়ে তার সুখের সংসার।

তিনি বলেন, “আমার এই ভাবনায়, কাজে সব রকমের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে আমার পরিবার। অনেকটা বলতে পারেন, গোটা পরিবারকে সঙ্গে নিয়েই আমি এগিয়ে যাচ্ছি। আমি থামতে চাই না’। মানসিক প্রশান্তির সঙ্গে শারীরিক সুস্থ্যতাকে গুরুত্ব দেন তিনি। আর সেই ভাবনাকে কেবল নিজের মধ্যে কিংবা নিজের পরিবারে সীমাবদ্ধ রাখতে চান না তিনি। ছড়িয়ে দিতে চান যতটা সম্ভব।

নাসির শিকদার বলেন ‘মানুষকে সচেতন করতে চাই। সেই সঙ্গে তাদেরকে সম্পৃক্ত করতে চাই। পৃথিবীর বুকে ভালো কিছু কাজের প্রভাব রেখে যেতে চাই।’ সেই চেষ্টার অংশ হিসেবেই দৌঁড়ান নাসির শিকদার। বিশ্বসেরা অ্যাথলেট হতে চান না তিনি। নিজে সুস্থ্য থাকতে চান, অন্যকে সুস্থ্য থাকার বার্তা পৌঁছে দিতে চান। সে কারণেই নাসির শিকদারের অন্যরকম দৌঁড় চলছে।